সংগৃহীত ছবি
মা-বাবার মৃত্যুর সময় কাছে থাকতে না পারা সন্তানের জন্য নিদারুণ কষ্টের বিষয়। শেষ কথাগুলো বলতে না পারা, জেনে-না জেনে দেওয়া কষ্টগুলোর জন্য ক্ষমা চাইতে না পারার যাতনা থেকে অনেকেই জানতে চান- মৃত বাবা-মায়ের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার কোনো উপায় আছে কি না।
এর জবাবে ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্য হলো—ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ না থাকলেও মৃত বাবা-মায়ের সাথে সদাচরণের সুযোগ ও তাদের জন্য সওয়াব পৌঁছানোর সুযোগ সন্তানের রয়েছে। সন্তানের উচিত সেই সুযোগ কাজে লাগানো। এতে করে মা-বাবার পাশাপাশি নিজেরও অনেক উপকার হবে। মৃত মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে, আবু উসাইদ (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল! বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার কোনো অবকাশ আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। চারটি উপায় আছে–১. তাঁদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা, ২. তাঁদের কৃত ওয়াদা পূর্ণ করা, ৩. তাঁদের বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা এবং ৪. তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং সুন্দর আচরণ করা। (আল আদাবুল মুফরাদ: ৩৫)
সদকা করা
মৃত মা-বাবার ঈসালে সওয়াবের জন্য সদকা করার শিক্ষা রয়েছে হাদিসে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা মৃত্যুবরণ করেছে। যদি আমি তার পক্ষে সদকা (দান) করি তাহলে এতে তার কোনো উপকার হবে? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, হ্যাঁ। এরপর লোকটি বলল, আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আমার একটি ফসলের ক্ষেত তার পক্ষ থেকে সদকা করে দিলাম। (সুনানে নাসায়ি: ৩৫৯৫)
হজ-ওমরা ও কোরবানির মাধ্যমে সওয়াব পৌঁছানো
মৃত মা-বাবার পক্ষ থেকে হজ, ওমরা, কোরবানি করেও সওয়াব উৎসর্গ করা যায়। (বুখারি: ১৮৫২; মুসলিম: ৫২০৩)
ঋণ পরিশোধ করা
বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তাদের ঋণ পরিশোধ করাও সন্তানের দায়িত্ব। জাবের (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নির্দেশে তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ বিন হারাম এর ঋণ পরিশোধ করেছিলেন। (বুখারি: ২৭৮১)
বাবা-মায়ের ভালো কাজ জারি রাখা, খারাপ কাজ বন্ধ করা
মৃত বাবা-মায়ের ভালো কাজগুলো জারি রাখার মাধ্যমেও বাবা-মায়ের সওয়াব জারি রাখা যায়। এতে নিজেরও সওয়াব লাভ হয়। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের ভালো কাজ শুরু করল, সে এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে। অথচ তাদের সওয়াব থেকে কোনো কমতি হবে না। (মুসলিম: ২৩৯৮)
মৃতব্যক্তি কোনো গুনাহের কাজ চালু করে গেলে তা সন্তান বন্ধ করবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে গুনাহের দিকে আহবান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ গুনাহ তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের গুনাহ থেকে কোনো কমতি হবে না। (মুসলিম: ৬৯৮০)
ছুটে যাওয়া নামাজের ফিদিয়া আদায় করা
বাবা-মায়ের ছুটে যাওয়া নামাজ-রোজার জন্য প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে এবং প্রতি রোজার পরিবর্তে এক মুদ (বর্তমান হিসাবে পৌনে দুই কেজি) পরিমাণ গম সদকা করা। ইকরিমা (রহ) বলেন, আমার মা প্রচণ্ড তৃষ্ণা-রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং রোজা রাখতে সক্ষম ছিলেন না। তাঁর সম্পর্কে আমি তাউস (রহ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, প্রতিদিনের পরিবর্তে মিসকিনকে এক মুদ (বর্তমান হিসাবে পৌনে দুই কেজি) পরিমাণ গম প্রদান করবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজজাক: ৭৫৮১)
ওয়াদা বাস্তবায়ন করা
বাবা-মা কোনো ওয়াদা করে গেলে তা বাস্তবায়ন করা সন্তানের দায়িত্ব। এমন ওয়াদা যা তারা বেঁচে থাকলে করে যেতেন, সন্তান যথাসম্ভব তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (সুরা বনি ইসরাঈল: ৩৪)
নফল নামাজ আদায় করা
সন্তান মৃত মা-বাবার জন্য নফল নামাজও আদায় করতে পারে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! জীবদ্দশায় আমি আমার মা-বাবার আনুগত্য করি। তাঁদের মৃত্যুর পর আমি তাঁদের আনুগত্য কীভাবে করব? তিনি বলেন, মৃত্যুর পর তাদের আনুগত্য হলো, তুমি নামাজ পড়ার সময় তাদের জন্য নামাজ পড়বে এবং তুমি রোজা রাখার সময় তাদের জন্য রোজা রাখবে। ’ (আওজাজুল মাসালিক ইলা মুয়াত্তা মালিক: পৃষ্ঠা-২৬৭)
কবর জিয়ারত করা
রাসুলুল্লাহ (স.) নিয়মিত মদিনার ‘বাকি’ কবরস্থান জিয়ারত করতেন। মৃত আপনজন, আত্মীয়-স্বজন ও সাহাবিদের জন্য দোয়া করতেন। চলার পথে কোনো কবর বা কবরস্থান পড়লেও মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (স.) মদিনার একটি কবরস্থান অতিক্রম করার সময় তার দিকে ফিরে বলেন— ‘হে কবরবাসী! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের মাফ করে দিন। তোমরা আমাদের অগ্রগামী, আমরা তোমাদের পদাঙ্ক অনুসারী। ’ (সুনানে তিরমিজি: ১০৫৩)
মানত পূরণ করা
মা-বাবা কোনো মানত করে গেলে, সন্তান তার পক্ষ থেকে পূরণ করবে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে—‘কোনো মহিলা রোজা রাখার মানত করেছিল, কিন্তু সে তা পূরণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করল। এরপর তার ভাই এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট আসলে তিনি বললেন, তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করো। (সহিহ ইবনে হিববান: ২৮০)
দোয়া করা
মৃত মা-বাবার জন্য দোয়া করা সন্তানের বিশেষ কর্তব্য। কবরে তাদের প্রশান্তির জন্য, মাগফিরাতের জন্য স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। যেমন— رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا উচ্চারণ: ‘রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানি সগীরা’ অর্থ: “হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’। (সুরা বনি ইসরাইল: ২৪)
মা-বাবার জন্য দোয়া প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে— رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ উচ্চারণ: ‘রাব্বানাগ ফিরলী ওয়াল ওয়ালিদাইয়া ওয়ালিল মু’মিনীনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব।’ অর্থ: ‘হে আমাদের রব, রোজ কেয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন’। (সুরা ইবরাহিম: ৪১)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবার গুনাহ ক্ষমা করে দিন। আমাদের প্রত্যেকের বাবা-মায়ের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিন। আমিন। সূএ:ঢাকা মেইল ডটকম